কেন মানুষ নাক ডাকে? নাক ডাকা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কি?

কেন মানুষ নাক ডাকে? নাক ডাকা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কি?
(১)মানুষ নাক ডাকে কেন?
শ্বাস নেওয়ার রাস্টার উপরিভাগের অংশে যদি কোনো কারণে বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় , তখন গলার মধ্যেকার পেশীসমূহের কম্পন জনিত শব্দই হচ্ছে নাক ডাকা। আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে শ্বসনতন্ত্রের কম্পন এবং ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধাগ্রস্ত বায়ু চলাচলের ফলে সৃষ্ট শব্দকেই নাক ডাকা বলা হয়ে থাকে ৷
অর্থাৎ যখন নাক এবং গলার মধ্য দিয়ে নিঃশ্বাস নেবার সময় বাতাস সঠিকভাবে চলাচল করতে পারে না তখন আশেপাশের টিস্যুগুলোতে কম্পনের সৃষ্টি হয়ে যে শব্দ উৎপন্ন হয় সেটাই হচ্ছে নাক ডাকা।
♦শরীরে বাড়তি ওজন, কিছুটা বংশগত কারণে তাছাড়া গর্ভাবস্থার করণেও মানুষ নাক ডেকে থাকে।
♦ অ্যালার্জি, নাক বন্ধ হওয়া অথবা নাকের ভিন্ন গঠনও নাক ডাকার একটি কারণ।
♦বয়স বেড়ে গেলে শরীরের চামড়া ঝুলে যায়, পুরু হয় এবং গলার কিছু পেশীও ফুলে যায়। এজন্য বয়স্করা নাক ডাকেন তুলনামূলক বেশি।
♦ধূমপান, মদ্যপান ও সাধারণত কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে মানুষ নাক ডাকার সৃষ্টি হয় ।
বলে রাখা ভালো; নাক ডাকা হচ্ছে নিদ্রাহীনতা ও শ্বাস-কষ্ট (অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপ্নিয়া ) রোগের প্রথম লক্ষণ।
(২) শ্বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটার কারণ কি ?
নাক থেকে স্বর যন্ত্র পর্যন্ত গঠনগতভাবে সরু থাকতে পারে, তাছাড়া অতিরিক্ত চর্বি গলার আশেপাশে জমে গিয়ে ওরকম বিপত্তি ঘটাতে পারে।গঠনগত বলতে এডিনরেডস বৃদ্ধি, টন্সিল, নাকের মধ্যে পলিপ বা কোনো টিউমার, নাকের পার্টিশন বাঁকা হলে উক্ত রাস্তা সরু হয়ে শ্বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ঘুমের সময় আমাদের শরীরের সব পেশী শিথিল হয়ে যায় । আর তখন গলার পেশীগুলি কাছাকাছি এসে গিয়ে উক্ত রাস্তাকে সরু করে দেয়। ফলে শ্বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
নাক ডাকা সাধারণত পুরুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। বয়স, ওজন কিংবা কিছু বিশেষ রোগ বাড়ার সাথে সাথে এর তীব্রতাও বাড়তে থাকে। এটা নিদ্রাহীনতার একটি লক্ষণ বলা চলে। কারণ যিনি নাক ডাকেন তার নিজেরও মাঝে মাঝে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে যা একসময় রুটিনে পরিণত হয়ে যায়।
(৩)সাধারণত নাক ডাকার প্রবণতা মানুষের মধ্যে কেমন?
এই ব্যাপারে বিভিন্ন পরিসংখ্যান আছে। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় যে শতকরা ৩০ ভাগের কিছু বেশি , পুরুষদের মধ্যে শতকরা ৩৪ শতাংশের কিছু বেশি হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২৬% এর কিছু বেশি হবে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা আরও বাড়তে থাকে। শরীরের ওজন স্বাভাবিকের থেকে বেশি হলেও নাক ডাকার প্রবণতার বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
(৪) নাক ডাকার ফলে কি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে?
upper air way স্বাভাবিকের থেকে সরু হলে “নাক ডাকা” শুরু হয়। যদি শ্বাসতন্ত্র এতটা সরু হয়ে যায় যে শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল একদম বন্ধ হয়ে যায়, তখন ওই ব্যক্তির পক্ষে সেটি মারাত্মক হয়ে ওঠে আর তখন সেই অবস্থাকে বলে “স্লিপ অপনিয়া” ইংরেজি (sleep apnoea)।
(৫)স্লিপ অপনিয়া কি ?
এটা হল ঘুমের মধ্যে শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া।
এটা মোটামুটি ৩ রকমের।
<(১)> central sleep apnoea- যেখানে মস্তিষ্কের সমস্যা মূলত কারণ। এখানে এই ব্যক্তি নাক ডাকতেও পারেন নাও পারেন।
<(২)> obstructive sleep apnoea-যেখানে রাস্তা সরু হয়ে যায়।
<(৩)> mixed apnoea- নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে ওপরের ২ রকমের সংমিশ্রণই হল এটি ।
(৬)নাক ডাকলেই কী sleep apnoea বলা যাবে?
এই উপসরগ থাকলে ডাক্তার সাহেব স্লিপ স্টাডি করে দেখবেন। স্লিপ ক্লিনিক গিয়ে polysomnography বলে কতগুলি টেস্ট করতে হবে।
এসব টেস্ট দিয়ে হার্ট, ব্রেন স্টাডি, ফুসফুস, ব্রিদিং প্যাটার্ন, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাপ ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া দেখে স্লিপ অপনিয়া আছে কিনা এবং কত মারাত্মক অবস্থায় আছে তা নির্ধারণ করা যায়।
নাক ডাকার এই অভ্যাস পুরোপুরি বদলানো না গেলেও এর তীব্রতা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।
১. ওজন কমানো
নাক ডাকার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত শরীরের অতিরিক্ত ওজন। বাড়তি ওজন নাকের ভেতরে বাতাস চলাচলের জায়গা সংকীর্ণ করে দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের সময় শব্দের সৃষ্টি করে। তাই ওজন কমালে এই সমস্যা অনেকটা দূর করা সম্ভব।
২. শুয়ার অবস্থান পরিবর্তন
সোজা এবং চিৎ হয়ে শুবার কারণে নরম তালু এবং জিহ্বা পেছনের দিকে হেলে যায়। যার কারণে মুখের ভেতরে বাতাস চলাচলের জায়গাটা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং নাক ডাকার সৃষ্টি হয়। ডান কাতে শোয়া এক্ষেত্রে খুবই ভালো একটি সমাধান। বাম কাতে শোয়ার জন্য বুকের উপর চাপ পড়তে পারে বেশি । তাই চিৎ বা বাম কাত থেকে ডান কাতে শোয়াটা একটি ভালো উপায়।
৩. মদ্যপান করা যাবে না
অ্যালকোহল শরীরের বিভিন্ন পেশীকে শিথিল করে দেয়। ফলে শিথিল মাংস পেশীগুলো মুখের ভেতরের জায়গা সংকীর্ণ করে দেয় । যা শরীরের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম
দৈনিক পর্যাপ্ত ঘুম (৭ থেকে ৯ ঘণ্টা) না হয়ে থাকে তাহলে নাক ডাকা বেড়ে যেতে পারে কিংবা হঠাৎ করে শুরুও হতে পারে। অতিরিক্ত ক্লান্তি শরীরের পেশীগুলোকে খুব অলস করে দেয় যা নাক ডাকার আরেকটি অন্যতম কারণ।
৫. নাসারন্ধ্র খোলা রাখুন
ঠাণ্ডাজনিত কারণে নাক বন্ধ থেকে থাকে তাহলে শুবার আগে গরম পানির ভাপ নিয়ে বা টাইগার বাম জাতীয় কোন কিছু দিয়ে যথাসম্ভব নাক পরিষ্কার করে ফেলুন।
৬. কক্ষ পরিষ্কার রাখুন
ধুলাবালিতে অ্যালার্জির কারণে নাক ডাকার সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই নিজের রুম সহ বাড়ি-ঘর সবসময় পরিষ্কার রাখুন। ফ্যান, আসবাবপত্র, বই-খাতা, চেয়ার-টেবিল এবং প্রাত্যহিক ব্যবহার্য জিনিসপত্র ঝেড়ে রাখুন।
৭. নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীরের বাড়তি মেদ কমান।
জিহ্বাকে উপরে তালুর দিকে ধাক্কা দিন এবং আস্তে আস্তে পেছনের দিকে নিন।জিহ্বার পেছনের অংশকে মুখের নিচের অংশে চেপে ধরুন। জিহ্বাকে উপরের দিকে চুষে নিন এবং আস্তে আস্তে পুরো জিহ্বা উপরের তালুতে চেপে ধরুন। জিহ্বার অগ্রভাগকে নিচের পাটির সামনের দাঁতে সাথে চেপে রাখুন।
৯. ধূমপানকে ‘না’ বলুন
সিগারেটের ধোঁয়া নাকের ভেতরে এবং গলার মেমব্রেন টিস্যুর ক্ষতি করে। গলার ভেতরের মাংসপেশী ফুলে যায়। আর তখনই নাক ডাকার লক্ষণ দেখা দেয়।
১০. জলের ভারসাম্য বজায় রাখুন
সারা দিনে প্রচুর পানি পান করুন। এতে আপনার নাক হাইড্রেটেড থাকবে ফলে নাক ডাকা কমে যাবে। সেই সাথে শরীরও সুস্থ থাকবে।
১১. উঁচু জায়গায় শোয়া বাদ দিন
ঘুমানোর সময় একটি বাড়তি বালিশ নিয়ে মাথাটা একটু উঁচু জায়গায় রেখে ঘুমানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। লক্ষ্য রাখুন যেন মাথা ও বুক সামঞ্জস্য বজায় থাকে। তা না হলে ঘাড়ে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হতে পারে।
১২. কক্ষের আর্দ্রতা বজায় রাখুন
কক্ষের আদ্রতা স্বাভাবিক থাকলে নাক ডাকা কমানো সম্ভব। কারণ শুষ্ক বাতাসে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। আর তাপমাত্র বজায় রাখা স্বাস্থ্যের পক্ষেও উপকারী।
১৩. ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন
নাক ডাকা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোনন।
সর্বোপরি ‘নাক ডাকা’ সুখকর নয়। নাক ডাকালে তা পাশের মানুষটির জন্যও ব্যাপারটি কষ্টদায়ক। তাই সহজ কিছু উপায়ে নাক ডাকা প্রতিরোধের চেষ্টা করা উচিত।